
‘কনশাস প্যারেন্টিং’ যে কারণে জরুরি – Why Conscious Parenting Matters
সন্তান কার না আদরের? এমন কোন মা-বাবা বা অভিভাবক কি খুঁজে পাওয়া যাবে যারা সচেতনভাবে সন্তানের অমঙ্গল চান? কেউ কি চাইবেন যে তার সন্তানটা ‘বিগড়ে’ যাক?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। তবুও কেন অনেক মা-বাবা প্রায়ই তাদের আদরের সন্তানকে নিয়ে হাঁ-হুতাশ করেন?
`আমার বাচ্চাটা না ঠিক মতো কিছু খেতেই চায় না।’ ‘আমার বাচ্চা রাতে ঠিক সময়ে ঘুমায় না বা রাতভর জেগে থাকে। ‘আমার বাচ্চা কারও সাথে মিশতে চায় না।’ ‘আমার বাচ্চাটা ভীষণ জেদি আর বদরাগি। যা চায় তা না পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হয় না।’ ‘পড়াশোনায় মনোযোগী না।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটু ভাবুন তো, নিজের অজান্তে এমন কোনো আচরণ করছেন না তো যা আপনার শিশুর অপূরণীয় ক্ষতি করছে? এমন ক্ষতি যা তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর জন্ম থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত তার মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রায় ৮০% সম্পন্ন হয়। অনেকে আবার বলেন, গর্ভাবস্থা থেকেই শিশুর মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ শুরু হয়ে যায়। সন্তান লালন-পালনে মা-বাবার অসচেতন আচরণ বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড শিশুর দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক-মানসিক ক্ষতি করতে পারে। এমনকি তার মানসিক বিকাশকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

তাই লালনপালনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা অবশ্যই জরুরিঃ
শুরু থেকেই রুটিন
নবজাতক শিশু দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা ঘুমায়। ঘুম শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বড় হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে শিশুর ঘুমের মাত্রা কমে আসে। ২-৩ মাস বয়স থেকেই শিশুকে প্রতিদিন রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে দুপুরের পর বা সন্ধ্যায় তাকে জাগিয়ে রাখুন। আর ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে শিশুর চাহিদা অনুয়ায়ী তাকে খাবার দিন আর ডায়াপার বা ভেজা কাঁথা পাল্টে দিন। দিনের ঘুমের ক্ষেত্রেও বয়স অনুয়ায়ী একটা নির্দিষ্টে রুটিনে ফেলে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর করার চেষ্টা করুন। কয়েক মাস এই রুটিন অনুসরণ করলে দেখবেন ‘আমার বাচ্চা রাতে ঘুমায় না’ এমন আফসোস করতে হবে না। বাচ্চার শরীর নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোয় অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

খাবারের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে খাবার দিন। একটু পর পর বাচ্চাকে খাওয়াবেন না। খিদে পেলে বাচ্চা নিজে থেকেই খাবে। ১-৬ মাসের শিশুদের প্রয়োজন অনুযায়ী (সাধারণত দেড়-২ ঘণ্টা পর পর) আর ‘সলিড’ খাবার আরম্ভ হলে শুরু অন্তত আড়াই-৩ ঘণ্টা অন্তর অন্তর খাবার দিন।
অতি তরল বা নরম খাবার খাওয়াবেন না
বাচ্চাকে কখনই ‘ব্লেন্ড’ করে, পিষে বা একদম তরল করে খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। সাড়ে ৫ বা ৬ মাস বয়স থেকে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি সলিড বা শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করা হয়। অনেক অভিভাবকের ধারণা, শিশুকে একদম নরম বা তরল করে না দিলে শিশু খেতে পারবে না। এটি একদমই ভুল ধারণা এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকর। শিশুকে শুরুতেই যে খাবারে অভ্যাস করবেন, জাউ অথবা খিঁচুড়ি, অবশ্যই সামান্য দানাদার রাখতে হবে। এতে শিশুর মুখের ভেতরে জিহ্বাসহ আরও যেসব পেশী আছে তা খাবার নাড়াচাড়া করে খেতে অভ্যস্ত হবে। ধীরে ধীরে খাবারের নরমভাব কমিয়ে আনুন। ৯ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে শিশুকে প্রতিদিন একটু একটু করে বড়দের জন্য রান্না করা খাবার থেকে খেতে দিন। এতে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

ডিভাইসকে ‘না’ বলুন
আজকাল অনেক মা-বাবাই বাচ্চার হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট সেট তুলে দিচ্ছেন। শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাই নিয়েই সময় পার করে দিচ্ছে। ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে বাচ্চা খাবার খেয়ে নিচ্ছে দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন হয়তো। এসব ডিভাইস থেকে যে ক্ষতিকর রশ্মি বের হয় তা তো শিশুর চোখের ক্ষতি করছেই পাশাপাশি এতে আসক্তি শিশু বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ র্দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ডিভাইসে আসক্ত শিশু আশপাশের বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাদের মনোযোগের অসুবিধা হয়। বিষন্নতায় ভোগে। অসামাজিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে।
এর পরিবর্তে শিশুকে শারীরিক খেলাধুলায় আগ্রহী করুন। বই পড়ে শোনান পাশাপাশি গান-সঙ্গীত শোনান। অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করতে উদ্বুদ্ধ করুন। সময় পেলেই পার্র্কে, মাঠে, খোলা জায়গা বা প্রকৃতির কাছে নিয়ে যান।

তুলনা করবেন না
প্রত্যেকটি শিশুই আলাদা। নিজের শিশুকে কখনোই অন্যের শিশুর সাথে তুলনা করবেন না। এতে শিশু হীনমন্যতায় ভোগে এবং নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এসব শিশুরা বড় হয়েও আস্থার সংকটে ভোগে। নিজের অভিভাবকের প্রতি অশ্রদ্ধা গড়ে ওঠে।
প্রশংসা করুন, উৎসাহ দিন
শিশুকে তার ইতিবাচক কাজ বা আচরণের জন্য প্রশংসা করুন। ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহ দিন। অযথা বকাবকি, মারধর করবেন না। নেতিবাচক কথা বলবেন না। কখনই শিশুকে অন্যের সামনে অপমান করবেন না বা তার সম্বন্ধে নেতিবাচক কথা বলবেন না। শিশু কথা শুনতে না চাইলে বা নেতিবাচক আচরণ করলে বুঝিয়ে দিন যে, আপনি এতে বিরক্ত হচ্ছেন না কষ্ট পাচ্ছেন। অন্যদিকে শিশু যখন আপনার কথা শুনে ইতিবাচক কিছু করবে তখন তার প্রশংসা করুন। ধন্যবাদ দিন। শিশুকে বলুন, তার প্রতি আপনার আস্থা আছে। এতে আপনার শিশু আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হবে।
ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সব শিশুকে ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে ঘরের কাজ, নিজের কাজ করতে উৎসাহিত করুন। আপনার সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সহযোগিতা করুন।

অতি মনোযোগ বা অতি অবহেলা কোনটাই না
শিশু যা চাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে এনে দিচ্ছেন? শিশু চিৎকার করছে আর সবাই ছুটে এসে তাকে আদরে ভাসাচ্ছেন, তার ইচ্ছাপূরণ করছেন? শিশু প্রয়োজনীয় খাবার খেতে চাচ্ছে না বলে তা না দিয়ে তুলে দিচ্ছেন ‘জাঙ্ক ফুড’? অভিভাবকদের এমন আচরণ শিশুকে জেদী, অনমনীয়, অবিবেচক ও অস্থির মানুষে পরিণত করে। চিৎকার করলেই যে কোন ইচ্ছাপূরণ হয়, এমন বার্তা শিশুকে দেবেন না। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। তাতে কাজ না হলে মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করুন। যা চাইবে তার সব তাকে দেবেন না। পাওয়া-না পাওয়া যে জীবনের অংশ, তা শিশুকে ছোটবেলা থেকেই বোঝাতে হবে।
অন্যদিকে, শিশুর সব ইচ্ছাই যদি অবহেলার চোখে দেখা হয়, খুবই কম সময় বা মনোযোগ দেওয়া হয় তাতেও শিশুর মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুকে আদর করুন, ভালোবাসুন, সময় দিন, তাকে গুরুত্ব দিন। সময় পেলে তার সাথে খেলুন।
উপদেশ নয়, আদর্শ হয়ে উঠুন
শিশুরা যতটা উপদেশ শুনে শেখে, তার চাইতে অনেক বেশি দেখে শিখে। তাই পারিবারিক পরিবেশ ও চর্চা শিশুর মানসিক ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে অত্যন্ত জরুরি। মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি চেঁচামেচি না করেন, একে-অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধাসূচক কথা বলা বা আচরণ করা থেকে বিরত থাকেন, বিবেচক হন, মিথ্যা না বলেন, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ করেন তবে শিশুও তেমনি ভাবেই বেড়ে উঠবে। তাই শিশুকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে তাকে উপদেশের বন্যায় না ভাসিয়ে নিজেরা তার সামনে আদর্শ মানুষ হয়ে উঠুন।

নিজের সন্তানই ‘শ্রেষ্ঠ’ নয়
আমার বাচ্চাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, অন্যের বাচ্চারা ভাল নয় এমন মনোভাব একদমই ঠিক নয়। এতে শিশু অতি অহমিকা নিয়ে বেড়ে উঠবে। অন্যদের সাথে মিশতে পারবে না। দলছাড়া হয়ে পড়বে। শিশুকে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিলে চলতে শেখান। সব বাচ্চাই ভাল এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন। অন্যেও প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিবেচক হিসেবে গড়ে তুলুন।
`কনশাস প্যারেন্টিং’-এর কথা শুনলে অনেকই হয়তো নাক উঁচু করে বলেন, ‘আমাদের মা-বাবারা কী আমাদের বড় করেননি? আমরা কী মানুষ হইনি?’ প্রশ্নটা নিজেকেই করুন। তখনকার পরিস্থিতি আর বাস্তবতার সঙ্গে আপনার বাস্তবতা সব মেলে কি না দেখুন। আর নিজেদের ‘জেনারেশন’-এর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ শতভাগ সঠিক কি না ভালো করে খতিয়ে দেখুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।